ব্রেকিং নিউজ ::
বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে বিশ্বস্ত গণমাধ্যম মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের প্রথম জাতীয় দৈনিক আমাদের’৭১ পত্রিকার প্রিন্ট ও অনলাইন সংস্করণে আপনাকে স্বাগতম। নতুন আঙ্গিকে প্রকাশিত প্রিন্ট কপির জন্য আজই হকারকে বলে রাখুন।।

রং-তুলির সুলতান নড়াইলের গর্ব

  • আপডেট টাইম : Wednesday, January 29, 2025
  • 68 Time View
ছবি-সংগৃহীত

বাপ্পী চৌধুরী :: চিত্রা নদীর কোল ঘেষে নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামে বেড়ে ওঠা বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের। পুরো নাম শেখ মোহাম্মাদ সুলতান। পরিবারের দেওয়া ডাকনাম ছিলো লাল মিয়া।  ঔপনিবেশিক শাসনামলে  দরিদ্র কৃষক পরিবারে ১০ই আগষ্ট ১৯২৩ সালে জন্ম হয় এই অগ্রপথিকের।

বাবা শেখ মেছের মিয়া এবং মায়ের নাম মোছাম্মাদ মেহেরুন্নেসা। একমাত্র বোন ফুলমণি। পিতা কৃষিকাজের পাশাপাশি বাড়তি আয়ের জন্য রাজমিস্ত্রী ও ঘরামীর কাজ করতেন।

পরিবারের সামর্থ্য না থাকলেও ১৯২৯ সালে পাঁচ বছর বয়সী সুলতানকে রুপগন্জ বাজারের জি টি স্কুলের নিকট একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। একই বছর মা মারা যান। বাবার  রাজমিস্ত্রী কাজের  সহকারী হওয়ায় অবসরে ছবি আঁকতেন । স্বভাবসুলভ প্রতিভার কারণে তৎকালীন জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় তাকে স্নেহ করতেন। মূলত ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের ভাতিজা অরুণ রায় প্রথম সুলতানকে ছবি আঁকা শেখানো শুরু করেছিলেন৷ ছবি আকার সরঞ্জাম ও তিনিই সরবরাহ করতেন। শৈশব থেকেই অরুন রায়ের মাধ্যমে বিখ্যাত মাস্টারপিস চিত্রকর্মগুলো দেখার সুযোগ মিলেছিলো সুলতানের। পঞ্চম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করার পর ১৯৩৪ সালে ভর্তি হন নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে। তার হাতে পেন্সিলে আঁকা নিজের স্কেচ দেখে শিক্ষাবিদ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি মুগ্ধ হন। এর মধ্য দিয়েই শিল্পী হিসাবে সুলতানের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর স্কুলের বদলে  নাকসী  এ বি এস জুনিয়র মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন৷ পিতার কাজে সহোযোগিতার পাশাপাশি  সুলতানের কাঠকয়লা দিয়ে আঁকার সুযোগ গুলো তার মধ্যে অনন্য এক শিল্পী প্রতিভার সৃষ্টি করতে থাকে। অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর কৃষ্ণনাথ ভট্টাচার্যের সাথে কলকাতা ভ্রমনে যান। স্কুলের লেখাপড়ায় মন না বসায় ১৯৩৮ সালে বিদ্যালয় ত্যাগ করেন। কিন্তু বিধি বাম, হয়ত দূর্ভাগ্যের অভিশাপে অভিশপ্ত সুলতান বয়স কম হওয়ায় কলকাতা স্কুল অব ফাইন আর্টসে ভর্তি হতে পারেন নি। কখনও থেকেছেন ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের বাড়িতে কখনও বা সত্যেন রায়ের বাড়িতে আর এভাবেই টানা তিন বছর তার ছবি আকার চর্চা চলতে থাকে। খরচের জন্য ত্রিশ টাকা পারিশ্রমিকে ভবানীপুরের কোন এক আর্ট সেন্টারে কাজ করতেন সুলতান, সাইনবোর্ড লেখা, পোস্টার কিংবা রিক্সায় অঙ্কন কিছুই বাদ দেননি তিনি।

১৯৪১ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে পনেরো মিনিটে ভেনাস মিলোর ছবি একে প্রথম হন সুলতান তবে প্রবেশিকা পাশ না থাকায় ভর্তি জটিলতায় পড়তে হয় তাকে। পরবর্তীতে ধীরেন্দ্রনাথের সহোযোগিতায় কলকাতা আর্ট স্কুলের পরিচালনা পরিষদের মাধ্যমে ভর্তি হন তিনি। তৎকালীন সময়ে কলকাতা আর্ট স্কুলের  ভিন্ন ভিন্ন ক্লাসে জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, আনোয়ারুল হকের মত বিখ্যাত মানুষেরা পড়াশোনা করতেন। তবে লেখাপড়া শেষ করতে পারেন নি তিনি। জানা যায়, চতুর্থ বর্ষে উঠে ছয় বছরের চারুকলা কোর্স অসম্পূর্ণ রেখে আর্ট স্কুল ছেড়েছিলেন তিনি৷

ভবঘুরে জীবন যাপন পছন্দ করায় এক জায়গায় বেশিদিন থাকেন নি যার জন্য হারিয়েছেন নিজের তৈরী অনেক কাজ যা থাকলে আজ হয়ত দূর্লভ হত । যোগ দিয়েছিলেন বিভিন্ন আন্দোলনেও। তার মধ্যে অন্যতম ছিলো খাকসার আন্দোলন। তার মন্তব্য উঠে এসেছে,

একেক জায়গায় এভাবে পড়ে আছে সব। শ্রীনগরে গেলাম। সেখানকার কাজও নেই। শ্রীনগরে থাকাকালীন পাকিস্তান হয়ে গেলো। ‘৪৮-সেখান থেকে ফিরে এলাম। কোনো জিনিসই তো সেখান থেকে আনতে পারিনি। একটা কনভয় এনে বর্ডারে ছেড়ে দিয়ে গেলো। পাকিস্তান বর্ডারে। আমার সমস্ত কাজগুলোই সেখানে রয়ে গেলো। দেশে দেশে ঘুরেছি। সেখানে এঁকেছি। আর সেখানেই রেখে চলে এসেছি।”

ধারণা করা হয়, রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্নের অভাবে কাঁঠকয়লা দিয়ে আঁকা অনেক কাজও হারিয়ে গিয়েছে।

১৯৪৭ এ ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্থানে ফিরে আসেন তিনি। পঞ্চাশের দশকে ফোর্ড এবং রকফেলার ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে অনুষ্ঠিত চিত্রশিল্পীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র যান তিনি। পরিদর্শন করেন বিভিন্ন ফটোগ্যালারী, ছবি আঁকেন এবং বিভিন্ন সভায় বক্তব্য রাখেন । শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনল হাউজ এবং মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিল্পকর্মের প্রদর্শনী হয়। এস এম সুলতানকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে তৎকালীন সময়ে নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোষ্ট, দ্যা টেলিগ্রাফ সহ বিভিন্ন পত্রিকায় তার কাজ প্রশংসিত হয়। পরবর্তীতে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া বাধ গার্ডেনে ওপেন এয়ার গ্রুপ প্রদর্শনীতে  পাবলো পিকাসো, সালভাদোর দালির মত বিশ্ববিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবির সাথে সুলতানের ছবি প্রদর্শিত হয়েছিলো। সারা ইউরোপজুড়ে বিশটির মত চিত্রপ্রদর্শনীতে সুলতানের জীবনমুখী ও আবহমান বাংলার রুপ আলোড়িত করেছিলো সারা বিশ্বকে। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীগুলোতে তার চিত্রকর্মের স্থান ছিলো প্রথম সারিতে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে তার প্রথম একক প্রদর্শনী হয়।

আহমদ ছফা তাকে কেন্দ্র করে লিখেছিলেন, কোনো কোনো মানুষ জন্মায়, জন্মের সীমানা যাদের ধরে রাখতে পারে না। অথচ যাদের সবাইকে ক্ষণজন্মাও বলা যাবে না। এরকম অদ্ভুত প্রকৃতির শিশু অনেক জন্মগ্রহণ করে জগতে, জন্মের বন্ধন ছিন্ন করার জন্য যাদের রয়েছে এক স্বভাবিক আকুতি। শেখ মুহাম্মদ সুলতান সে সৌভাগ্যের বরে ভাগ্যবান, আবার সে দুর্ভাগ্যের অভিশাপে অভিশপ্ত।’

এস এম সুলতান ল্যান্ডস্কেপ, তেলরং, জলরং এ একেছেন। রেঁনেসার চিত্রকর্মের সাক্ষ্য বহন করে তার ছবিতে। ছবিগুলোয়  কৃষক, নারী, শিশু সহ পশু পাখি পর্যন্ত স্থান পেয়েছিলো। কৃষকদের বীরত্ব কিংবা হাস্যজ্জল -প্রানবন্ত দৃশ্য অথবা স্বেচ্ছাচারী নারী সবই তার ভরাট ক্যানভাসে ফুটে উঠেছিলো। চটের হোক বা মোটা কাগজে আঁকা প্রতিটি ছবির দিকে তাকালে মনে হয় এক একটি জীবন্ত গল্প যেন ক্যানভাস ফুড়ে বেরিয়ে আসার অভিপ্রায়ে সরব। এস এম সুলতানের বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলো হল, প্রথম বৃক্ষেরোপন ( ১৯৭৫),চরদখল (১৯৭৬), শাপলা তোলা(১৯৮৬), জমি কর্ষণ ১ ( ১৯৮৬), জমিকর্ষণে যাত্রা ২ ( ১৯৮৯),হত্যাযজ্ঞ ( ১৯৮৭) মাছকাটা (১৯৮৭)।

এস এম সুলতান বলেছিলেন, শিল্পের কখনো পুরষ্কার হয়না শিল্পের ভার তো প্রকৃতি স্বীয় হাতে প্রদান করে”।  তিনি ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট খেতাব, “ম্যান অব এশিয়া খেতাব “, একুশে পদক, স্বাধীনতা দিবস পুরষ্কার সহ নানান পুরষ্কারে ভূষিত হন। বর্তমানে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী” সুলতান স্বর্ণ পদক ” নামে একটি পুরষ্কার প্রদান প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।  প্রতি বছর তার জন্মদিনে একজন বিশিষ্ট শিল্পীকে এ পুরষ্কার প্রদান করা হয়।

হয়ত দীর্ঘ কালো কুর্তা পরিহিত লম্বা বাবরী চুলের এই  রং – তুলির সুলতানকে তামাক পোড়া মিষ্টি ঘ্রাণমূখর পরিবেশে আর কখনও শাড়ি পড়ে ঘুঙুর পায়ে নাচতে দেখা যাবেনা। শোনা যাবেনা এই সুরসাধকের  হৃদয় তোলপাড় করা বাশির সুর। দেখা যাবেনা  তার পোষা বিড়াল জাহাঙ্গীর, আওরঙ্গজেব, দারাশিকো, শাহজাহান কিংবা বাবর কে। তবে তার সৃষ্টি, সমাধী ও স্মৃতি রয়ে গিয়েছে নড়াইলের মাছিমদিয়ায়।  ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এস এম সুলতান সংগ্রহশালায় রয়েছে তার ৭৭ টি শিল্পকর্ম। দোতালা এ যাদুঘরে শিল্পীর ব্যবহৃত পোষাক, রং তুলি, কোরআন, বাদ্যযন্ত্র, লাঠি, টর্চ, আয়না, ফুলদানী ও ক্যানভাস চোখে পড়বে৷ সুলতান কমপ্লেক্সের পাশে সুলতানের তৈরী নৌকা ” শিশুস্বর্গ ” সংরক্ষিত আছে।

অন্তিম বয়সে চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান নড়াইলে শিশুস্বর্গ এবং যশোরে চারুপিঠ নামে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন যেখানে শিশুদের ছবি আঁকা শেখানো হতো। তাছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এস এম সুলতান বেঙ্গল চারুকলা মহাবিদ্যালয় বর্তমানে নড়াইলে সচল রয়েছে। ১০ ই অক্টোবর ১৯৯৪ সালে যশোরের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তার তিরোধান ঘটে।

নিজের অনাড়ম্বর জীবন যাপন, সাধারণ খাদ্যাভাসের জন্যই হয়ত তিনি শেষ বয়সে লিখে গিয়েছিলেন,“আমি সুখী। আমার কোনো অভাব নেই। সকল দিক দিয়েই আমি প্রশান্তির মধ্যে দিন কাটাই। আমার সব অভাবেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে।”

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর...
All rights reserved @ The Daily Amader 71
Site Customized By NewsTech.Com