ব্রেকিং নিউজ ::
বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে বিশ্বস্ত গণমাধ্যম মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের প্রথম জাতীয় দৈনিক আমাদের’৭১ পত্রিকার প্রিন্ট ও অনলাইন সংস্করণে আপনাকে স্বাগতম। নতুন আঙ্গিকে প্রকাশিত প্রিন্ট কপির জন্য আজই হকারকে বলে রাখুন।।

আমি গ্রামের ছেলে : মুহিবুল্লাহ মুহিব

  • আপডেট টাইম : Wednesday, October 16, 2024
  • 57 Time View

কংক্রিটের শহরে চারদিকে টাকা আছে, আভিজাত্য আছে, সাথে আছে এক রাশ কর্কশতা

আমি গ্রামের ছেলে। গ্রামের কৃষক পরিবারে জন্ম আমার। যেখানে এখনকার তথাকথিত সভ্যতা তখন পৌঁছায়নি। ছোট বেলায় বেড়ে উঠেছি একান্নবর্তী পরিবারে। যেখানে বাবা-মা, ভাই-বোন, চাচা-চাচী, ফুফা-ফুফু, চাচাতো ভাই-বোন, ফুফাতো ভাই-বোন, কাজের মানুষ, সবাই মিলেই ছিলো পরিবার। কাজের মানুষকে কখনো পরিবার থেকে আলাদা করে দেখিনি। বর্ষায় হাল চাষ থেকে বীজ রোপন পর্যন্ত আবার ধানকাটা মৌসুমে ধান মারাই পযর্ন্ত বাড়িতে থাকতো কাজের মানুষ। হাল চাষের জন্য যাদের তিন মাসের কন্ট্রাক্ট এ নেয়া হতো, তাদের বলা হতো “হালিয়া” অনেক এলাকায় যাদের “কৃষাণ” বা “মুনি” নামে চেনে। কখনো তাদের বলা হতো ” মাসঠিয়া”। হালিয়া বা মাসঠিয়াদের সাথে কাচারি ঘরে একাকার হয়ে থাকতাম আমরা। একসাথে নাওয়া, একসাথে খাওয়া, একসাথে ঘুমোনো- মাত্র তিন মাসে ভীষণ সখ্যতা হতো আমাদের। ওরা ঘুমিয়ে গেলে হেরিকেনের আলোয় পড়তাম আমরা। ফতেপুর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক “শারাফাত উল্লাহ” স্যারও তখন একইসাথে থাকতেন আমাদের কাচারিতে। লজিন বাড়িতে শুধু স্যার থাকতেন না, স্যারের ছোট্ট ছেলে শফিক, বড় ছেলে শহীদ থাকতো। দশমিনা মাঝে মাঝে স্যারের স্ত্রীসহ পুরো পরিবার আসতো বেড়াতে। দূরের একটা অপরিচিত মানুষ, সরকারি স্কুলে চাকরি করার সুবাদে এসেছেন আমাদের এলাকায়। আমার দাদা, বাবা-চাচারা, কী যে আপন করে নিতেন লজিন মাস্টারদের!।

স্যার চলে যাওয়ার পর অন্য স্যার আসতেন। কাচারিটা জমজমাটই থাকতো। আমরা চার ভাইবোন (তখনও মিরাজ-মশিউরের জন্ম হয়নি) আর চাচাতো ভাইবোন সবাই মিলে পড়তাম একই টেবিলে, স্যারের সামনে। আজান হলে দাদু অথবা বড় চাচার ইমামতিতে নামাজ পরতাম জামায়াতে। ভোরবেলা দাদুর আজানে ঘুম ভাঙ্গতো সবার। ফজরের নামাজটাও বাড়ির ছেলে, বুড়ো সবাই একসাথে আদায় করে নিতাম। বর্ষাকালে ফজরের নামাজ শেষ করে হালিয়ারা (কৃষাণ) ছুটতো লাঙ্গল-জোয়াল আর গরু নিয়ে। সূর্য ওঠার পর হালিয়াদের জন্য ভাত নিয়ে যেতাম ক্ষেতে (কোলায়)। বর্ষার পিচ্ছিল আইল (জমির ডিমার্কেশন করা চিকন রাস্তা) দিয়ে ভাত নিয়ে যাওয়ার পথে কতবার যে হালিয়ার খাবার নিয়ে পড়ে গেছি, তার হিসেব নেই। কাঁদায় খাবার পড়ে যাওয়ায় সে ভাত আর তুলে খাওয়ার অবস্থা থাকতো না। বাড়িতে ফিরে মাকে আবার রান্না করতে বলতাম। রান্না শেষ হলে বেলা ১১টা বেজে যেত হালিয়াদের সকালের নাস্তায়। মাঝেমধ্যে কৃষাণের খাবারের সাথে নিজের খাবারটাও নিতাম। ক্ষেতে বসে ওদের সাথে সকালের খাবার খেয়ে নেয়ার অন্যরকম এক আনন্দ ছিলো। গ্রামের মানুষ যারা ফজরে ঘুম থেকে উঠে কাজে বেরিয়ে যায়, তাদের নাস্তাটা সকাল সাতটায় না সারলে কষ্টটা কেমন হয়, তা কেবল আমার মতো গ্রামের মানুষের জানে। এখনকার মতো তখন কলের লাঙ্গল ছিল না। জোড়ায় জোড়ায় গরু/মহিষের কাঁধে জোয়াল আর লাঙ্গলেই ছিল ভরসা। জমিতে এক চাষ, দুই চাষ করে মই দেয়া এর পর বীজ রোপনের উপযোগী করা, এতেই লেগে যেত তিন মাস।

জমিতে লাঙ্গল টানতে টানতে তাদের সমবেত কণ্ঠের গান-

“বাড়ির পাশে বেতের আড়া,

হাল জুইড়াছে ছোট্ট দেওড়া…

আজও কানে ভাসে।

এখন নাকি কলের লাঙ্গলের যুগে রোপনকাল মাত্র ২সপ্তাহে।

বীজ রোপনের শেষ দিনের আনন্দটা ছিলো একটু ভিন্ন রকম। একদিকে তিন মাসের অমানসিক শ্রমের পরিসমাপ্তি, অন্যদিকে হালিয়াদের বিদায় ঘিরে নানা আয়োজন। সবমিলিয়ে এ ছিল ভিন্ন এক আবহ। বাড়িতে হালিয়া বিদায়ে তৈরি হতো নানা আইটেমের পিঠাপুলি। বাড়ির মানুষগুলোর সঙ্গে তিন মাসে হালিয়াদের তৈরি হতো এক মায়ার বাঁধন। যে বাঁধন ছিন্ন করা ছিলো ভীষণ কষ্টের। তখন কী মায়া ছিলো মানুষের মাঝে! কাজের মানুষের প্রতি কী অসীম মমতা ছিলো তখন! আর এখন শহুরে জীবনে চারপাশে যা দেখছি, কংক্রিটের শহরে চারদিকে টাকা আছে, আভিজাত্য আছে, সাথে আছে এক রাশ কর্কশতা। শুধু মায়াটা নেই। নেই মানুষের জন্য মানুষের ভালবাসা আর মমত্ববোধ।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলা ভিশন

লেখা : লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর...
All rights reserved @ The Daily Amader 71
Site Customized By NewsTech.Com