কথায় আছে, চুম্বকের ছোঁয়ায় লোহাও চুম্বকে পরিণত হয়। ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনির ছোঁয়ায় অনেকে এখন শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। এদের অন্যতম আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের সাবেক এক ইউপি সদস্য নুরুল আবছার। চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএলএ) এবং কর্ণফুলী ফার্টাইলাইজার কোম্পানি (কাফকো), কোরিয়ান ইপিজেড ইউনাইটড পাওয়ার প্লান্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে একক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও সার চুরি, ইয়াবা পাচারের মাধ্যমে টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি।
সম্প্রতি কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার মাধ্যমে দেশ-বিদেশের মানুষ জেনেছে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ কীভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচার করেছেন। কীভাবে তিনি বিদেশে ৮ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির বিশাল পাহাড় গড়েছেন। মানুষ জেনেছে, সাইফুজ্জামান কুমির ও উট পাখির চামড়ায় তৈরি ১০ লাখ টাকা দামের জুতা পরিধানসহ তার বিলাসী জীবনযাপনের কথা।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও তার স্ত্রী রুকমিলা জামান কেবল নিজেরাই বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েননি। সাইফুজ্জামানের ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি ও তার স্ত্রী ইমরানা জামান চৌধুরীও বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। লন্ডন, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে তাদেরও। আর বিলাসিতায় সাইফুজ্জামানের চেয়ে ছোট ভাই আনিসুজ্জান চৌধুরী রনি এক কাঠি সরেস। লন্ডন-দুবাই-বেভারলি হিলসে পার্সোনালাইজড নম্বর প্লেটসহ বহু মূল্যবান সব গাড়ি আর বাড়ি আছে তার। রিচার্ড মিলের প্রায় ৪ লাখ ডলারের হাতঘড়ি পরেন রনি। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৪ কোটি ৭৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এই ধরনের অসংখ্য ঘড়ি রয়েছে রনির সংগ্রহ শালায়।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত আখতারুজ্জামানের সন্তান আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আগে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। আর সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের স্ত্রী রুখমিলা জামান চৌধুরী ছিলেন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান। দেবর-ভাবি মিলে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন লোকজনের নামে সরিয়ে নিয়েছেন। আর সেই টাকায় আনিসুজ্জামান রনি এবং তার স্ত্রী ইমরানা জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে খুলেছেন পাঁচটি কোম্পানি।
সিইউএফএল এবং কাফকো সার কারখানায় রনির একক ব্যবসার সিন্ডিকেট রয়েছে। গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে দুইটি সার কারখানার সার পরিবহন থেকে শুরু করে কোটি কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। রনির অন্যতম সহযোগী ছিলেন আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার নুরুল আবছার।
বৈরাগ ইউনিয়নের উত্তর বন্দর গ্রামের হতদরিদ্র ইটভাটার নিরাপত্তা কর্মী জাফর আলীর প্রথম স্ত্রীর দ্বিতীয় পুত্র নুরুল আবছার। প্রাইমারি স্কুলের চৌহদ্দি পার হননি তিনি। অভাবের কারণে একসময় ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নবী হোসেনের গৃহপালিত গরু-মহিষ দেখাশোনা করতেন। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আবছার ইউপি সদস্য হন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সিইউএফএ ও কাফকো থেকে নবাব খানের নেতৃত্বাধীন বিএনপির সিন্ডিকটকে বিতাড়িত করেন তিনি।
এভাবেই নুরুল আবছার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরীর ছেলে আনিসুজ্জামান রনির কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। হতদরিদ্র রাখাল আবছার এখন শত শত কোটি টাকার মালিক। উত্তর বন্দর গ্রামে তার ক্রয় করা ৪০ শতক জায়গার সামনের অংশে রয়েছে দোকান-মার্কেট এবং পেছনের অংশে রয়েছে ৫ তলা বিলাসবহুল বাড়ি। ব্যবহার করেন একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি।
এই আবছার রনির হয়ে বিদেশে অর্থ পাচারে অন্যতম সহযোগী। এই ভূমিকার পুরস্কার হিসেবে আবছার রনির কাছ থেকে উপহার পেয়েছেন হোন্ডা কোম্পানির এসইউভি গাড়ি। এ ছাড়া তার রয়েছে হোন্ডা ভেজেল ও টয়োটা প্রিমিও ব্র্যান্ডের কার। আবছারের মালিকানাধীন কোম্পানি এস এ এন্টারপ্রাইজ (ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ০০২২১০১০০০০১১২১৮) ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা হতে ৩০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। এই অর্থের পুরোটাই রনি হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করে দিয়েছেন বিদেশে। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ছাড়াও রনির সহযোগিতায় একাধিক ভুয়া-ভূঁইফোঁড় কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে নামে-বেনামে আবছার এবং তার ছেলে জয়নাল আবেদিন যে ঋণ নিয়েছেন তা দেশে বিনিয়োগ করেননি।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, আবছারের ছেলে জয়নাল আবেদিনের কাহিনিও। জয়নাল ছিলেন বিভিন্ন সমুদ্রগামী জাহাজের একজন ক্রু, তার পিতা আবছার অশিক্ষিত হওয়ায় তিনি সব ডকুমেন্টারি কাজ দেখভাল করতেন। তার নিজের রয়েছে চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় নামে-বেনামে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও গাড়ি। রয়েছে অসংখ্য ব্যাংক এফডিআর।
আবছারের বিরুদ্ধে সিইউএফএল সার কারখানার ডিলারদের জিম্মি করে শতকোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। বিসিআইসি নিয়ন্ত্রণাধীন সিইউএফএল সার কারখানার নিজস্ব উৎপাদিত অথবা কাফকো হতে ক্রয়কৃত কিংবা বিদেশ হতে আমদানিকৃত সার তাদের নিজস্ব গোডাউন থেকে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের তালিকাভুক্ত ডিলারদেরকে চাহিদামতো সরবরাহ করে থাকে। সে ক্ষেত্রে ডিলাররা সার পরিবহনের জন্য যে গাড়ি সরবরাহ করেন, তা ১০-১৫ মে টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন।
বর্তমানে আবছার এবং তার ছেলে নিয়োজিত আছেন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন বাফার গুদামে সার পরিবহনের কাজে। দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে কাজ নিলেও ওই কাজের আড়ালে তাদের মূল ব্যবসা অন্যকিছু। সরকারি সারের গাড়িতে ইয়াবা পাচার করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সময় গুলিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়ার মৃত্যুর ঘটনার মামলায় ১১৪ নং আসামি এই নুরুল আবছার। অভিযোগের বিষয়ে জানতে নুরুল আবছারের মোবাইলে ফোন করা হলেও মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। খবর চিত্র- সময়ের আলো