গতকাল (মঙ্গলবার) আবু সাঈদকে গুলি করে মারার ভিডিওটা দেখার পর থেকে মাথার ভেতরে সব বোধ ভোঁতা হয়ে আছে। বারবার মনে হচ্ছে আবু সাঈদ তো আমার সন্তানও হতে পারতো, সে তো আমারই সন্তানের মতো, বিশ্ববিদ্যালয়রে শিক্ষার্থী। ছেলেটার কি অপরাধ! সে তো একটা ককটেল বা ঢিলও মারেনি পুলিশকে। বুক চিতিয়ে সাহস নিয়ে দাঁড়ানো, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা বা দাবি আদায়রে জন্য পথে নামা কোন আইনে কোন বিচারে অপরাধ?
আবু সাঈদের ফেসবুক প্রফাইল দেখলাম। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র বা আওয়ামী লীগ সরকার কারো সম্পর্কে কোনো বাজে কথা বা বাজে পোস্ট তার প্রফাইলে দেখিনি। তার দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মানের অভাব আছে বলেও মনে হয়নি।
একটা ২৪/২৫ বছরের মেধাবী এবং সাহসী যুবক যেরকম তেজি হবার কথা আবু সাইদ সেই রকম তেজি এক যুবক। সে মিনমিনে, সুবিধালোভী, চাটুকার বা পদলেহী নয়। হয়ত সেজন্যই তার এই পরিণতি। তার বোনের একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, ভদ্র মহিলা আহাজারি করছে ভাইকে নিয়ে আর বলছে, তার ভাই কত মেধাবী ছিলো, ফাইভে বৃত্তি পেয়েছে, এইটে বৃত্তি পেয়েছে, স্কুল কলেজে ভালো ফল করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, তার স্বপ্ন বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে ঢুকবে, অভাবের সংসারের অভাব দূর করবে, মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে! সেই স্বপ্নবাজ, নির্দোষ ছেলেটাকে কি না ঘরে ফিরতে হলো লাশ হয়ে! এসব ভাবতে ভাবতে আমার কাল একটা নির্ঘুম রাত কাটলো, চোখের জলে, বুকের ব্যথায়।
কোনো মৃত্যুর দৃশ্যই দেখার যোগ্য না। কিন্তু আবু সাঈদের মৃত্যুর দৃশ্যটা দেখে মনে হয়েছে যেন বাচ্চাদের ভিডিও গেম, কেউ একজন সামনে পড়লো, অমনি তাকে গুলি করে দিলো! যখন প্রথম গুলি লাগলো, আমি নিশ্চিত সাঈদ তখনও বুঝতে পারেনি যে পুলিশ সত্যি সত্যি তাকে গুলি করেছে। সে গুলিবিদ্ধ অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করলো, তারপর আবারও গুলি, বুকে বা পেটে, ছবিতে ভালো বোঝা যাচ্ছিলো না। এবার আর দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি থাকলো না, বসে পড়লো। বন্ধুরা এসে হাত পা ধরে তাকে তুলে নিয়ে গেলো। সিনেমার গুলির মতো রক্তে সব ভেসে গেলো না। কিন্তু একটা মহা মূল্যবান তাজা প্রাণ ঝরে গেলো! আমার মনে হলো আমার সামনে লুটিয়ে পড়লো রফিক, শফিক, সালাম, বরকত বা নূর হোসেন; যারা শুধুমাত্র অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে এসে, অধিকার চাইতে এসে এমনি করে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন।
মানুষ মারা এত সহজ? যিনি মেরেছেন তাকে আমরা ভিডিওতে দেখেছি। তার কপাল এমনই খারাপ যে গুলি করার মুহূর্তে তার হেলমেটটি মাথা থেকে সরে যায়, চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হেলমেট না সরলেও যে তার পরিচয় বের করা যেতো না তা নয়। কিন্তু এখন নিজে থেকেই মুখটা সামনে চলে এসেছে। এই লোকটার কথাও আমি ভেবেছি কাল রাতে। সে কী মনে করে এত কাছে থেকে একজন নিরপরাধ মানুষকে গুলি করলো? তাকে কি কোনো উর্ধতন কর্মকর্তা গুলি করার নির্দেশ দিয়েছে? পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য গুলি করার নির্দেশ অনেক সময় দেয়া হয়, কিন্তু তাও কোমরের নিচে- এমন বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো মানুষের বুকের উপরে নয়। আর ওখানে তো এমন পরিস্থিতিও হয়নি যে পুলিশ জীবন বাঁচাতে এলোপাথারি গুলি ছুঁড়েছে। এই গুলিটা দেখলে মনে হয় শুধুই আবু সাঈদকে মারতেই গুলি করা হয়েছে।
খুনীর নাম সম্ভবত ইউনুস। ইউনুস সাহেব কি এর আগেও মানুষ মেরেছেন? তিনি কি ক্রস ফায়ারে অভিজ্ঞ? তিনি পুলিশের লোক, পুলিশ কি আইনের উর্ধে? তার কি মৃত্যুদণ্ড হবে? নিজের বিবেকের কাছে তিনি কি জবাব দিচ্ছেন? চেহারা সুরত দেখে তো তাকে ধার্মিক মনে হয়। আল্লাহর কাছেই বা তিনি এর কি জবাব দেবেন? তাকে হ্ত্যা মামলার আসামী করে বিচারের মুখোমুখি করা যাবো কি না তাও জানি না। তারও তো পরিবার আছে, সন্তান আছে। তাদের কাছে তিনি কি জবাব দেবেন? কি করে মুখ দেখাবেন তার সন্তানকে?
এমন নানা এলেবেলে ভাবনার মাঝে যে কথাটা মাথায় ঘুরছে সেটা হলো, ইউনূসের এই অপকর্ম নিয়ে এখনো পুলিশ বাহিনীর কারো কোনো বক্তব্য পেলাম না। না আইজিপি, না রংপুরের কোনো পুলিশ কর্মকর্তার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পাথরের মতো নিশ্চুপ। তারা সবাই কি বোবা হয়ে গেছেন! অন্তত এটুকু বলুন মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে- এটা একটা বিচ্ছিন ঘটনা! অথবা বলুন আবু সাঈদ বিএনপি জামাতের লোক, সে রাজাকার, তাকে গুলি করে মারা দোষের না!
আমি জানি না আবু সাঈদ হত্যার বিচার কবে হবে বা আদৌ হবে কি না। তার বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জে। সেখানকার খুবই গরীব পরিবারের সন্তান সাঈদ। ছয় ভাইবোনের সবার ছোট। পীরগঞ্জে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্বশুরবাড়ি। সেখানকার বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শীরিন শারমিন চৌধুরী। মাননীয় স্পিকার, আপনি নিজের ক্ষমতায়, নিজের নির্বাচনী এলাকার এমন একটা বীভৎস হ্ত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করুণ, একটা সংসদীয় তদন্ত কমিটি করুন। আবু সাঈদ হত্যার বিচারের ব্যবস্থা করুন।
(লেখাটি এটিএন বাংলা’র প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ. ই মামুন এর ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নেওয়া)